শত বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আছে কুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুর গ্রামের জমিদার বাড়িটি। সুশোভিত ফুলের নকশা আর অসাধারণ শিল্পকর্মময় এ বাড়ির প্রবেশ পথের প্রধান ফটকে থাকা সিংহ মূর্তিগুলো যেন জমিদারবাড়ির আভিজাত্যের নিশান হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
বাড়িতে এখন হাতি আর ঘোড়া না থাকলেও টিকে আছে হাতিশালা ও আস্তাবল। অনেকটাই সুনসান বাড়িটির জরাজীর্ণ ভবনগুলোর ধূসর ইট আজও জমিদার বংশের প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে। এখন বাড়িতে তাদের চতুর্দশ বংশধরেরা বসবাস করছেন। বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন দর্শনার্থীরা। বাড়িটি মুরাদনগর উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। যে কোনো যানবাহনে সহজে যাতায়াত করা যায়।
সরেজমিনে জমিদারবাড়ি ঘুরে দেখা গেছে, ওই বাড়িটি অসংখ্য নারকেল ও বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। গাছের ছায়ায় শীতল পরিবেশ বিরাজ করছে। বাড়ির সামনে বড় পুকুর, আছে শানবাঁধানো ঘাট। বাড়িতে প্রবেশের প্রধান ফটকে রয়েছে দুটি সিংহের মূর্তি। এর একটি ইতোমধ্যে ভেঙে পড়েছে। বাড়িতে প্রবেশের পর প্রথমেই যে কারো নজর কাড়বে একটি বিশাল দোতলা ভবন। এ বাড়ির মোট ১০টি ভবনের মধ্যে একটি তিন তলা, বাকি ৯টি দোতলা। প্রতিটি ভবনই ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত। ভবনগুলো কোনটা আই টাইপ, কোনটা এল টাইপ। সবগুলো ভবনেই কারুকার্যময় সুশোভিত ফুলের নকশা রয়েছে। জানালার গ্রিল ও দরজাগুলোতে নকশা রয়েছে। ভবনগুলোয় রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। তবে এরই মধ্যে দুটি ভবন নষ্ট হয়ে গেছে।
অন্য ভবনগুলোর বেশির ভাগই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। শত বছরের পুরোনো ইতিহাস যেন লতাগুল্মে ঢেকে যাচ্ছে। একটি ভবনে দেখা গেছে, ফ্লোর থেকে ছাদের উচ্চতা ১৪ ফুট। ছাদের নিচের অংশে কাঠের ও লোহার তৈরি কারুকাজের সিলিং। সরু সিঁড়ি বেয়ে এ বাড়ির ছাদে গেলে প্রায় তিন একর আয়তনের পুরো জমিদার বাড়ির মনোরম দৃশ্য দেখে যে কারোই মণ ভরে যাবে।
ভবন ঘুরে জমিদারদের ব্যবহৃত শতবর্ষের পুরোনো শৌখিন খাট, নকশা করা চেয়ার, গা এলিয়ে দেওয়ার ইজি চেয়ার, কারুকার্যখচিত ফুলদানি, হ্যাজাক লাইট, সেগুন কাঠের তৈরি নকশা করা আসবাবপত্র, ‘মেইড ইন লন্ডন’ লেখা সেই সময়ে পানি বিশুদ্ধ করার ফিল্টার, বিয়েতে বরবরণে ব্যবহৃত একটি রূপার তৈরি ছাতাসহ দুর্লভ অনেক কিছুই দেখার আছে।
বাড়ির সামনে বিশাল বটগাছের কাছে ১৩২৪ বঙ্গাব্দে জমিদার অশ্বিনী কুমার রায় প্রতিষ্ঠিত একটি ঘরে এখনো জগন্নাথ দেবের উঁচু রথ রাখা আছে। প্রতি বছর রথযাত্রার সময় হাজার হাজার ভক্ত সেখানে সমবেত হন।
এখন বাড়িটিতে বসবাস করছেন জমিদারদের চতুর্দশ বংশধর অধ্যাপক অঞ্জন কুমার রায়, তার ভাই অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায়, চাচাতো ভাই বিশ্বজিত কুমার রায় ও তাদের পরিবার। তারা বাড়িটি দেখাশোনা করছেন, বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই পুরোনো স্মৃতি।
নোয়াখালী থেকে স্ত্রী ও সস্তান নিয়ে জমিদার বাড়িতে ঘুরতে আসা কলেজ শিক্ষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ইতিহাস ঘেঁটে জেনেছি জাহাপুরের জমিদাররা ছিলেন প্রজাদরদি। বাড়িটি ঘুরে দেখেছি। চারশ বছর আগেও বাড়ি তৈরিতে এমন অসাধারণ শিল্পকর্মের সন্নিবেশ দেখে মনে বিস্ময় জেগেছে।
জমিদারদের চতুর্দশ বংশধর অধ্যাপক অঞ্জন কুমার রায় জানান, এ বাড়িটিতে তাদের বংশের বসবাস প্রায় ৪০০ বছর আগের। ১৮৬২ সালে তারা ঢাকার নওয়াবদের কাছ থেকে জমিদারি ক্রয় করেন। জমিদারি বিস্তৃত ছিল মুরাদনগর, দাউদকান্দি, মেঘনা, তিতাস, চান্দিনা, দেবীদ্বার ও নবীনগরে। বংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন কানাই লাল রায়। জমিদারি শুরু করেন সপ্তম পুরুষ গৌরী মোহন রায়। নবম পুরুষ কমলাকান্ত রায় ও তার ছেলে গিরিশ চন্দ্র রায়ের সময় জমিদারির জৌলুস ও গৌরব বৃদ্ধি পায়।
এ প্রসঙ্গে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান জানান, জমিদার বাড়িটি খুব শিঘ্ররই পরিদর্শনে যাবো সংরক্ষণের উপযুক্ত হলে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো। সূত্র : বাসস
শত বছরের জাহাপুর জমিদার বাড়ি
88