অস্ট্রেলিয়া প্রতিনিধি
সিডনির বুকে লেখা হলো ইতিহাস। ২০২৫ সালের এক বৃষ্টিমুখর রোববার সিডনির আইকনিক হারবার ব্রিজে ফিলিস্তিনের পক্ষে এক অভূতপূর্ব জনস্রোত দেখা গেল—লাখো মানুষ তাদের কণ্ঠে তুলে নিল ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘স্টপ দ্য জেনোসাইড’-এর মতো প্রতিবাদী স্লোগান। আয়োজকদের দাবি, অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ২ থেকে ৩ লাখ ছাড়িয়েছে। এ মিছিলে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিও অংশ নেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সমাজকর্মী ও সাবেক কাউন্সিলর, অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া পদকপ্রাপ্ত সাবরিন ফারুকী ও তাঁর ছেলে।

উত্তপ্ত প্রেক্ষাপট : মিছিলটি ঘিরে এক সপ্তাহ ধরেই ছিল প্রশাসনিক টানাপোড়েন। নিউ সাউথ ওয়েলসের মুখ্যমন্ত্রী ক্রিস মিন্স ও পুলিশ প্রশাসন নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মিছিলের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং রাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। তবে আদালত পুলিশের আবেদন খারিজ করে মিছিলের পক্ষে রায় দেয়। এর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা দেয় প্রতিবাদের ঢেউ—মানুষ ঘোষণা দেয়, কোনো বাধাই তাঁদের এই ঐতিহাসিক পদযাত্রা থেকে থামাতে পারবে না।
জনসমুদ্রের সাক্ষী হারবার ব্রিজ : দুপুর ২টার আগেই উত্তর সিডনির রেলস্টেশনগুলো ভরে ওঠে মিছিলকারীদের ভিড়ে। লাল, কালো, সাদা ও সবুজ রঙের পতাকায় ছেয়ে যায় চারপাশ। ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ, হুইলচেয়ারে বসা প্রতিবন্ধী থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী—সবাই এক কণ্ঠে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ান। পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় ৯০ হাজার মানুষ অংশ নেয়, যদিও আয়োজকদের দাবি—এই সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে।
সাবরিন ফারুকী বলেন, “এটা শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়, এটা মানবতার পক্ষের অবস্থান। আমি দেখে মুগ্ধ হয়েছি—প্রায় ৯০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী অমুসলিম। সবাই একসঙ্গে কাঁদছিলেন ফিলিস্তিনের জন্য। এই দৃশ্য আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকবে।”
উৎসবের আবহ, কিন্তু গভীর বেদনা : প্রতিবাদের পাশাপাশি ছিল আবেগ আর প্রতিবাদের উষ্ণতা। বিশ্বখ্যাত অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বব কার এবং মানবাধিকারকর্মী হান্না থমাস এই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন। থমাস, যিনি আগের এক বিক্ষোভে পুলিশের হাতে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন, এবার ফিলিস্তিনি পতাকার রঙের আইপ্যাচ পরে অংশ নেন মিছিলে।
বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিলের স্লোগান আরও জোরালো হয়ে ওঠে—
“Free, Free Palestine!”
“Stop the Genocide!”
“In Our Millions, We Are All Palestinians!”
হারবার ব্রিজ ও আশপাশের এলাকা কেঁপে উঠেছিল সেই উচ্চারণে।

পুলিশের উদ্বেগ, শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি : এত বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে পুলিশের মধ্যে উদ্বেগ ছিল প্রবল। ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, “আমরা আশঙ্কা করছিলাম ভিড়ে পিষ্ট হওয়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত চাপের।” তবে শেষ পর্যন্ত মিছিল শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়, বিক্ষোভকারীরা পুলিশের নির্দেশ মেনেই এগিয়ে যান।
ইতিহাসে লেখা এক দিন : বিকেল পাঁচটার দিকে হারবার ব্রিজ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তবে শহরের কেন্দ্রস্থলে তখনো জড়ো ছিল হাজারো মানুষ। আয়োজক সংগঠন ফিলিস্তিন অ্যাকশন গ্রুপের নেতা জশ লিস বলেন, “আজকের দিনটি শুধু একটি মিছিল নয়, গণতন্ত্রের জয়। লাখো মানুষ আজ তাঁদের মতপ্রকাশের অধিকার ব্যবহার করেছেন।”
বৃষ্টিভেজা সিডনির সন্ধ্যায় মানুষ ধীরে ধীরে ঘরে ফিরছিল, কিন্তু তাঁদের কণ্ঠে তখনো গুঞ্জন করছিল ফিলিস্তিনের মুক্তির আকুতি। দিনটি অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে—যেখানে জাতি, ধর্ম, পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ এক হলো মানবতার পাশে দাঁড়াতে।